যৌথ নদীর পানি ব্যবহারে আন্তর্জাতিক আইন রেটিফাই (অনুমোদন) করার এখনই উপযুক্ত সময়। এটা সম্ভব হলে আমরা এক ধাপ এগিয়ে যাব। পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে যাওয়ার কথা বলেছেন। সেখানে যেতে হলে আমাদের একটা পথ লাগবে। এই আইনে সই করা মানে, আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের পথ উন্মুক্ত হওয়া। এটা দ্রুত আমাদের সই করা উচিত। এটা না করার ফলে যৌথ নদীর পানি নিয়ে ভারত একের পর এক নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
ভারতের চোখ রাঙানির ভয়ে আগের সরকারগুলো এই চুক্তিতে সই করেনি। এখন আমাদের অনেক বিশেষজ্ঞ মুখ খুলছেন। আগের সরকারগুলোর সঙ্গে এসব বিশেষজ্ঞ নানাভাবে যুক্ত থাকার কারণে তারা তখন কথা বলতে পারেননি।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে সমস্যা আছে। তারা শুকনো মৌসুমে পানি দেয় না আবার বন্যার সময় গেট খুলে দেয়, এটা সত্যি।
কিন্তু এই সমস্যাটা আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে কূটনৈতিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়, জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়ে কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলতে হবে।
একসময় মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন। তার একটা প্রভাব তৈরি হয়েছিল। ভারত তিস্তায় পানি দেয় না, এজন্য আমাদের সবাই তিস্তা ব্যারাজ পর্যন্ত যায়। কিন্তু গজল ডোবায় যেতে চায় না। তিস্তা ব্যারাজ তো আমার দেশের মধ্যে। তিস্তায় গিয়ে আমাদের লাভটা কী? শুধু মুখে বললে হবে না, পারলে লংমার্চ করে গজল ডোবা পর্যন্ত যেতে হবে। বাংলাবান্ধা বা তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তো যাওয়াই যায়। নিজের বাড়ির উঠানে লাঠি নিয়ে লাফালাফি করে লাভ কী?
বর্তমান সরকারের নতুন উপদেষ্টারা বন্যা ইস্যুতে কথা বলেছেন। এটা একটা নতুন অবস্থান। একটা পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের মিডিয়া আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে হেনস্তা করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টারা এই অবস্থান নিয়েছেন। এটা সরকারের পলিসি হতে পারে। সরকার যদি মনে করে এই বন্যার রাজনৈতিক কারণ রয়েছে, তাহলে কালবিলম্ব না করে বন্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতিগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তথ্য পাওয়ার দিক থেকে কোনো ঘাটতি নেই। ভারতকেই তথ্য দিতে হবে–বিষয়টি এমন নয়। কারণ, বর্তমান যুগে তথ্য জানার নানা উপায় রয়েছে। এক সোর্স থেকে না পেলে আরেক সোর্স থেকে পাওয়া সম্ভব। সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ অধিদপ্তরসহ অন্য যাদের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, তাদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি।
দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের দুর্যোগ অধিদপ্তরকে বিশ্বের রোল মডেল বলা হয়! এটা আমার কাছে অতিরঞ্জিত কথা বলে মনে হয়। কারণ, গণতন্ত্রের মানসকন্যাও তো রোল মডেল ছিলেন। সমাজে এই ধরনের চাটুকারিতামূলক কথাবার্তা প্রচলিত রয়েছে। আমি খুব অবাক হয়ে যাই যখন দেখি ফেনীতে যখন মানুষ ডুবছে, তখন তাদের উদ্ধারে ঢাকা থেকে স্পিডবোট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বহু আগ থেকেই এসব কথা বলেছি। উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য জেলা ও উপজেলায় পর্যায়ে দুর্যোগ অধিদপ্তর বা এ ধরনের কমিটির কাছে কাঠের নৌকা থাকা দরকার, স্পিডবোট নয়। সাবেক মন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সঙ্গে অনেক টকশোতেও বলেছি। এটা তারা করেননি, হয়তো স্পিডবোট কিনতে ৫ লাখের স্থলে ৫০ লাখ টাকা বিল করা যাবে, কাঠের নৌকায় হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। তাই করেননি।
এখন বৃষ্টি কমছে, পানিও নেমে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসনের প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে, তা নিয়েও আমার সন্দেহ রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্নভাবে ত্রাণ আসছে এবং সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যখন কোনো ত্রাণ কার্যক্রম চলে, তখন সরকারি ত্রাণ এবং বেসরকারি ত্রাণ দুটিই তছরুপ হয়। ত্রাণ সংগ্রহে সমস্যা নেই, সমস্যা বিতরণে। বন্যায় ডুবে মারা যাওয়ার খবর মিললেও এখন পর্যন্ত না খেয়ে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের সমাজ অনেক বেশি মানবিক। ভিক্ষুককে হয়তো ভিক্ষা দেবে না, কিন্তু কেউ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। অনেক দেশেই এটা নেই। দুর্যোগ মোকাবিলায় এটাই আমাদের মূল শক্তি।
এখন বিশেষ একটা সংকটকালীন মুহূর্ত যাচ্ছে। আমি লক্ষ্য করছি, পুলিশ ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিস্থিতিও বেহাল। এজন্য হয়তো দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি আমরা ওইভাবে নিতে পারিনি বা প্রস্তুতিটা সরকারিভাবে সেভাবে হচ্ছে না।
এখন যে বিতর্কটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ ভারত কিছু না জানিয়ে ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। একটা লেভেলে উঠে গেলে পানি অটোমেটিক বেরিয়ে যাবে। জলাধারের একটা স্তর আছে, তার ওপরে উঠে গেলে এমনিতেই উপচে যায়। ডুম্বুরের পানির পরিমাণ গোমতী অববাহিকার ২০ শতাংশ এলাকা কাভার করবে। এই গেট খোলার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হবে কুমিল্লার ওপর দিয়ে। ডুম্বুরের গেটের পানিতে ফেনী ডুবেনি, ডুবছে মুহুরী নদীর পানিতে। মুহুরীতেও ভারতের অংশে একটা ব্যারাজ রয়েছে, যেটা অনেক ছোট এবং আমাদের সীমানা থেকে অনেক দূরে। এবার পুরো এলাকাজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে, অস্বাভাবিক মাত্রায়। এই বৃষ্টির কারণে আগরতলা ডুবে গেছে, সেটা কিন্তু ডুম্বুর পানিতে নয়।
ফেনীর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাহাড় (ভারতের অংশে)। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে খোলা। পানিটা উত্তর দিক থেকে এসে নিচু এলাকা হিসেবে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। অতি বৃষ্টিপাতের কারণে ফেনীতে পানি আসবেই। সিলোনিয়া নদীটাও পশ্চিম দিকের পাহাড় থেকে বেরিয়েছে এবং উত্তর দিকে ঢুকেছে মুহুরী নদী। বিশাল এলাকার পানি নিয়ে এই নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানকার ভূপ্রকৃতি দেখতে হবে, কেন এই কাণ্ডটা ঘটল। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, বন্যার পানি দেরিতে নামার কারণ কী? এর কারণ হলো, সোনাগাজী রেগুলেটর ভরাট হয়ে গেছে। মিরেরসরাই আর সোনাগাজী দুই উপজেলায় মিলে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের মতো চর পড়ে গেছে। ফলে সাগরে পানি নামতে সময় লাগছে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট